বৈশম্য ও হয়রানির শঙ্কায় বিব্রত মুক্তিযোদ্ধারা
দেশে মুক্তিযোদ্ধাদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রস্তুতকরনে যাচাই-বাছাইয়ের লক্ষে পুনরায় সংশোধিত খসড়া তালিকা প্রকাশ করে মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়। যা নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের মাঝে মিশ্র প্রতিক্রিয়া চলছে।
তালিকায় চাঁদপুর জেলার হাজীগঞ্জ উপজেলায় ৭ জন শহীদ মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযোদ্ধের সংগঠক ও ভারতীয় তালিকার নামসহ মোট ২৫২ জন মুক্তিযোদ্ধার নাম রয়েছে। এ ঘটনায় উপজেলা জুড়ে মুক্তিযোদ্ধাদের মাঝে চরম ক্ষোভ বিরাজ করছে।
২৫২ জনের প্রকাশিত এই তালিকায় সাতজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধা রয়েছে। তাঁরা হলেন, সুবিদপুর গ্রামের শহীদ আবু তাহের, রাধাসারের শহীদ জয়নাল আবেদীন, সমেশপুর গ্রামের শহীদ এসএম জহিরুল, মকিমাবাদ গ্রামের শহীদ আলী আজ্জম, সেন্দ্রা গ্রামের শহীদ এমদাদুল হক, কীর্তনখোলা গ্রামের শহীদ আব্দুর রশিদ, উত্তর শ্রীপুরের শহীদ রফিকুল ইসলাম।
হাজিগঞ্জ উপজেলার সাধারন মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষ থেকে বলা হয় জামুকার অনুমোদন নাই এমন অজুহাতে ২০০৪-২০০৫ সালের গেজেট ভুক্তদের যাচাই বাছাই করা হচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে, জামুকার অনুমোদন আছে কি নাই, তাতো সাধারণ মুক্তিযুদ্ধাদের জানার কথা নয়। যদি কোনো গাফিলতি থাকে সে জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দায়ী। সাধারণ মুক্তিযোদ্ধাগণ দায়ী নন। অথচ ২০১০ সাল পর্যন্ত জামুকার কার্যক্রম শুরুই হয় নাই। জামুকার অজুহাতে যাচাই-বাছাইয়ের বিষয়টি হাস্যকর এবং আইন সম্মত নয়।
ইতোমধ্যে (২০০৪-২০০৫)যারা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সরকারি গেজেটভুক্ত হয়েছেন, তাঁদেরকে পুনরায় যাচাই-বাছাই করার পক্রিয়া শুরু হয়েছে, তাতে মুক্তিযোদ্ধাগন অপমান বোধ করছেন। এরা বিভিন্ন সময়ে যাচাই-বাছাইয়ের প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই গেজেটভুক্ত হয়েছেন।
এদিকে ২০১০ সালের পরে যারা গেজেটভুক্ত হয়েছে তারা স্থানীয়ভাবে কোন ধরনের যাচাই বাছাই প্রক্রিয়া ছাড়াই জামুকার সাথে যোগসাজশের মধ্য দিয়েই গেজেটভুক্ত হয়েছেন।
যাচাই-বাছাইয়ের আয়োজন সম্পর্কে সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের মহাসচিব হারুন হাবীব বলেন, জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল থেকে নতুন করে প্রায় ৪০ হাজার কিংবা তারও বেশি সরকারি গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধাকে নিজ নিজ উপজেলায় উপস্থিত হয়ে যাচাই-বাছাইয়ের সম্মুখীন হতে বলা হয়েছে। যখন-তখন যাচাই-বাছাইয়ের নামে যেভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের হয়রানির সম্মুখীন করা হচ্ছে, তা মোটেও কাম্য নয়। এতে একদিকে বীর মুক্তিযোদ্ধারা হেনস্তার শিকার হচ্ছেন, অন্যদিকে নানা স্তরে দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়ার অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। স্বাধীনতার ৪৯তম বার্ষিকীতে এসে এমন পদক্ষেপ অতীব দুঃখজনক ও একান্ত অনভিপ্রেত।’
তিনি বলেন, জাতীয় বীরদের তালিকা অবশ্যই চূড়ান্ত হতে হবে। কোনো অমুক্তিযোদ্ধা মুক্তিযোদ্ধার তালিকাভুক্ত হয়ে থাকলে তাঁকে অবশ্যই বাদ দিতে হবে। সে ক্ষেত্রে অভিযুক্ত কিংবা সন্দেহভাজনদের ব্যাপারে তদন্ত হতেই পারে। কিন্তু ঢালাওভাবে সবার নাম প্রকাশ করা খুবই বিব্রতকর, অবমাননাকরও। তা ছাড়া গেজেট প্রকাশ করে সরকার। এতে ত্রুটি থাকলে সেটা সরকারি কর্মকর্তাদের ত্রুটি। এই দায় অন্যদের ওপর বর্তায় না।
জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের (জামুকা) গত ৩ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত ৭১তম সভায় ২০০২ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত ‘বেসামরিক গেজেট’ভুক্ত মুক্তিযোদ্ধাদের সনদ পুনরায় যাচাই-বাছাইয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, মুক্তিযোদ্ধাদের ভারতীয় তালিকা বা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ প্রণীত লাল মুক্তিবার্তায় নাম অন্তর্ভুক্ত না থাকা সত্ত্বেও এবং জামুকার সুপারিশ ছাড়া যাঁদের নাম বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ‘বেসামরিক গেজেটে’ প্রকাশিত হয়েছে, তাঁরা প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা কি না যাচাই-বাছাই করা হবে।
জামুকার সুপারিশ ছাড়া যাঁদের নাম বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বেসামরিক গেজেটে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে—এমন ৩৮ হাজার ৩৮৬ জনের তালিকা ৩০ জানুয়ারি যাচাই-বাছাই করা হবে। ।
যাচাই-বাছাইয়ের আওতাভুক্ত তালিকা ও এ-সংক্রান্ত বিস্তারিত তথ্য মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট (www.molwa.gov.bd) এবং জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের ওয়েবসাইটে (www.jamuka.gov.bd) দেয়া হয়েছে।
এর আগে যাচাই-বাছাইয়ের জন্য ৩৯ হাজার ৯৬১ জনের তালিকা প্রকাশ করা হয়েছিল। তালিকা প্রকাশের পর দেখা যায়, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় স্বীকৃত বিভিন্ন প্রমাণপত্রে নাম থাকার পরও অনেক বীর মুক্তিযোদ্ধার নাম যাচাই-বাছাইয়ের তালিকায় রয়েছে। পরে এই তালিকা থেকে ১ হাজার ৫৯৫ জন বীর মুক্তিযোদ্ধার নাম বাদ দেওয়া হয়।
৯ জানুয়ারির পরিবর্তে ৩০ জানুয়ারি বীর মুক্তিযোদ্ধাদের যাচাই-বাছাই কার্যক্রম অনুষ্ঠিত হবে। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
জামুকার ৭১তম সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, বেসামরিক গেজেট নিয়মিতকরণের লক্ষ্যে যাচাইযোগ্য বীর মুক্তিযোদ্ধাদের এদিন (৩০ জানুয়ারি) সকাল ১০টায় নিজ নিজ উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কার্যালয়ে, মহানগরের ক্ষেত্রে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে সাক্ষ্য, তথ্য-উপাত্তসহ উপস্থিত থাকতে বলা হয়েছে।
জামুকার ৭১তম সভায় তাদের অনুমোদন ছাড়া যেসব বীর মুক্তিযোদ্ধার নাম বেসামরিক গেজেটে প্রকাশিত হয়েছে, তা যাচাই-বাছাইয়ের সিদ্ধান্ত হয়। প্রথমে ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে যাচাইয়ের কাজটি শেষ করতে চেয়েছিল জামুকা। পরে ৯ জানুয়ারি যাচাই-বাছাইয়ের তারিখ চূড়ান্ত করা হয়। এখন যাচাই-বাছাইয়ের নতুন তারিখ ৩০ জানুয়ারি ঠিক করা হলো।